জীবাণুমুক্ত নয় জারের পানি

হাওর বার্তা ডেস্কঃ বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ হওয়া সত্ত্বেও এখানে সুপেয় পানির তীব্র সংকট রয়েছে। বিশেষ করে রাজধানী ঢাকায় সুপেয় পানি বা নিরাপদ পানির সংকট ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। ওয়াসার পানি পানের অযোগ্য হওয়ায় গত কয়েক বছরে বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের জারের পানির দিকে ঝুঁকছে অনেকে। অধিকাংশ জারের পানি পান করে মোটেও নিরাপদ নয়- ২০১৭ সালে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল (বিএআরসি) গবেষণা তথ্যে এমনটাই উঠে এসেছে।

দুই বছর পর এ অবস্থার কোনো উন্নতি হয়নি বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট গবেষকরা। বিএআরসি ২০১৭ সালে এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, ঢাকার বাসাবাড়ি, অফিস-আদালতে সরবরাহ করা ৯৭ ভাগ জারের পানিতে ক্ষতিকর মাত্রায় মানুষ ও প্রাণীর মলের জীবাণু ‘কলিফর্ম’ পাওয়া গেছে। ওই গবেষক দলের প্রধান ছিলেন বিএআরসির পুষ্টি বিভাগের পরিচালক ড. মনিরুল ইসলাম। গতকাল তার কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, পরিস্থিতির আগের মতোই আছে, মোটেও উন্নতি হয়নি।

গবেষণার জন্য রাজধানীর ফার্মগেট, কারওয়ান বাজার, এলিফ্যান্ট রোড, নিউমার্কেট, চকবাজার, সদরঘাট, কেরানীগঞ্জ, যাত্রাবাড়ী, মতিঝিল, বাসাবো, মালিবাগ, রামপুরা, মহাখালী, গুলশান, বনানী, উত্তরা, এয়ারপোর্ট, ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুর, মিরপুর, গাবতলী, আমিনবাজার, আশুলিয়া ও সাভারসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে ২৫০টি নমুনা সংগ্রহ করেন তিনি এবং তার গবেষণা দলের সদস্যরা।

গবেষণা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, সংগ্রহ করা নমুনাগুলোতে টোটাল কলিফর্মের ক্ষেত্রে প্রতি ১০০ মিলিলিটার পানিতে সর্বনিম্ন ও সর্বোচ্চ মাত্রা পাওয়া গেছে যথাক্রমে ১৭ ও ১৬০০ এমপিএন (মোস্ট প্রবাবল নম্বর) এবং ফেকাল কলিফর্মের ক্ষেত্রে প্রতি ১০০ মিলিলিটার পানিতে সর্বনিম্ন ও সর্বোচ্চ মাত্রা ছিল যথাক্রমে ১১ ও ২৪০ এমপিএন। এর মধ্যে এলিফ্যান্ট রোড, চকবাজার, বাসাবো, গুলশান ও বনানী থেকে সংগ্রহ করা পানির ননুনায় উল্লেখযোগ্য মাত্রায় টোটাল কলিফর্ম ও ফেকাল কলিফর্মের উপস্থিতি পাওয়া যায়।

এতে আরও উল্লেখ করা হয়, টোটাল কলিফর্ম ও ফেকাল কলিফর্ম পরিমাণ পানির সম্ভাব্য দূষণের পরিমাণ নির্দেশ করে। টোটাল কলিফর্ম পরিমাপে পানিতে প্রাকৃতিকভাবে বিদ্যমান এবং মানুষসহ অন্যান্য প্রাণীর অন্ত্রে উপস্থিত অণুজীব ও মলমূত্র দ্বারা দূষণের সম্মিলিত মান পাওয়া যায়। আর ফেকাল কলিফর্ম পরিমাপের মাধ্যমে শুধু মানুষসহ অন্য প্রাণীর অন্ত্র ও মলমূত্রের দ্বারা দূষণের মাত্রা নির্দেশিত হয়।

গবেষক দলের প্রধান মনিরুল ইসলাম আরও বলেন, টোটাল কলিফর্ম কাউন্টের মাধ্যমে নিশ্চিতভাবে বলা যায় না পানিতে উপস্থিত অণুজীব স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারক কি না? সে জন্য পানিতে কলিফর্মের উপস্থিতি পাওয়া গেলে ফেকাল কলিফর্ম কাউন্ট করা অত্যাবশ্যক। পানিতে টোটাল কলিফর্ম ও ফেকাল কলিফর্মের পরিমাণ শূন্য থাকার কথা থাকলেও ৯৭ ভাগ জার পানিতে দুটোরই উপস্থিতি রয়েছে, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।’

গত দুই বছরে এর উন্নতি হয়েছে কিনা জানতে চাইলে গতকাল তিনি বলেন, মোটেও উন্নতি হয়নি। যেটা হয়েছে তা হলো আগে তেমন কোনো অভিযান চালানো হতো না। এখন র‌্যাব-পুলিশ নিয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হচ্ছে। নিয়মিত অভিযান পরিচালনা হচ্ছে। তবে পানির এখনো উন্নতি হয়নি। আগে যে রকম ছিল এখনো সেরকমই আছে। তিনি বলেন, গত দুদিন ধরে ওয়াসা যা বলছে তারা কিভাবে তা বলে। নগরবাসীর প্রতি তার পরামর্শ পানি ফোটানো হোক বা না হোক ফিটকারি দিলে পানি কিছুটা বিশুদ্ধ হয়।

তিনি আরও বলেন, কলিফর্ম মূলত বিভিন্ন রোগ সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস ও প্রোটোজোয়ার মতো প্যাথোজেন সৃষ্টিতে উৎসাহ জোগায় বা সৃষ্টি করে। বিভিন্ন রোগ সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়া বিশেষ করে ই-কোলাই (কলিফর্ম গোত্রের অণুজীব) মানবদেহে দীর্ঘস্থায়ী ডায়রিয়া, মাথাব্যথা, বমিভাব, পেটব্যথা, জ্বর-ঠান্ডা, বমির মতো নানা উপসর্গ সৃষ্টির পাশাপাশি ক্রমাগত মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। সংক্রমণের মাত্রা বেশি হলে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু এবং ষাটোর্ধ্ব মানুষের হেমোলাইটিক ইউরেমিক সিনড্রোম হতে পারে। এ রোগের কারণে ক্রমান্বয়ে লোহিত রক্তকণিকা ধ্বংস হয়ে যায় ও অনেক ক্ষেত্রে কিডনিতে মারাত্মক সমস্যা দেখা দেয়। এমনকি কোনো কোনো পরিস্থিতিতে ব্লাড ট্রান্সফিউশন অথবা কিডনি ডায়ালাইসিস করার মতো অবস্থা দাঁড়ায়।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পৃথিবীর উন্নত রাষ্ট্রগুলোয় স্যুয়ারেজের লাইন এবং পানির লাইন কমপক্ষে ৮ ফুট দূরে থাকে কিন্তু বাংলাদেশে তা দেখা যাচ্ছে না। বাংলাদেশে দুটি লাইন পাশাপাশি থাকায় অনেক সময় দুর্ঘটনাবশত স্যুয়ারেজের লাইন ও পানির লাইন মিশে গিয়ে স্যুয়ারেজের ময়লা ওয়াসার লাইনে গিয়ে পানি নষ্ট হয়ে যায়।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর